বাংলা কবিতা
প্রকৃতপক্ষে বাংলা কবিতার উৎপত্তি হয়েছিল পালি এবং প্রাকৃত সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতি থেকে। এটি বৈদিক ধর্মীয় ধর্ম অনুষ্ঠান এবং বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম এর রীতিনীতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরস্পর বিরোধি ছিলো। তবে এটি আধুনিক বাংলার সংস্কৃত ভাষার উপর ভিত্তি করে তৈরী হয় নি।
বাংলা সাহিত্য কাল বিচারে বাংলা সাহিত্যকে তিনটি (০৩) প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথাঃ (০১)প্রাচীন যুগ ,(০২)মধ্যযুগ ও (০৩)আধুনিক যুগ। প্রাচীনযুগের কালসীমা ছিল (৬৫০-১২০০), মধ্যযুগের কালসীমা ছিল (১২০১-১৮০০)ও আধুনিক যুগের কালসীমা হল ১৮০১ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত। মধ্যযুগকে আবার তিনভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ আদি-মধ্যযুগ, মধ্য-মধ্যযুগ ও অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৭০০-১৮০০)। আদি মধ্যযুগের কালসীমা ছিল (১২০০-১৩৫০), মধ্য-মধ্যযুগের কালসীমা ছিল (১৩৫০-১৭০০) ও অন্ত্য-মধ্যযুগের কালসীমা ছিল(১৭০০-১৮০০)। অনুরূপভাবে আধুনিক যুগও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত যায়ঃ প্রস্ত্ততিপর্ব (১৮০০-১৮৬০), বিকাশের যুগ (১৮৬০-১৯০০), রবীন্দ্রপর্ব (১৯০০-১৯৩০), রবীন্দ্রোত্তর পর্ব (১৯৩০-১৯৪৭) এবং বাংলাদেশ পর্ব (১৯৪৭-)।
প্রাচীন যুগ
চর্যাপদ হল বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্যিক নিদর্শণ। ধারণা করা হয় এটি নব্য ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শণ। খ্রিস্টীয় ১০ম থেকে ১২শ (দশম-দ্বাদশ) শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যগণ। চর্যাপদের ২৪ (চব্বিশ) জন পদকর্তার সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁরা হচ্ছেন লুই পা, দারিকপা, কুক্কুরীপা, বিরুপা, গুণ্ডরীপা, চাটিলপা, জঅনন্দিপা, ভুসুক পা, কাহ্নপাদ, কাম্বলাম্বরপা, ডোম্বীপা, শান্তিপা ,মহিত্তাপা, বীণাপা, সরহপা, শবর পা, আজদেবপা, ঢেণ্ঢণপা, ভাদেপা, তাড়কপা, কঙ্কণপা , ধামপা, তান্তীপা, লাড়ীডোম্বীপা।
মধ্যযুগ
বাংলা সাহিত্যের ১২০১-১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কালকে “অন্ধকার যুগ” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সময় রচিত হয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যার রচয়িতা বড়ুচন্ডিদাশ। এছাড়া বৈষ্ণব পদাবালী সাহিত্যের কবিগণ হলেন বিদ্যাপতি, বংশীবদন, বলরাম দাস, বাসুদেব, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, ফতেহ পরমানন্দ, ঘনশ্যাম দাশ, গয়াস খান, আলাওল, দীন চন্ডীদাস, চন্দ্রশেখর, হরিদাস, শিবরাম, করম আলী, পীর মুহম্মদ, হীরামনি, ভবানন্দ যশোরাজ খান , চাঁদকাজী, রামচন্দ বসু, নরহরি দাস, অনন্ত দাস, লোচন দাস, শেখ কবির, সৈয়দ সুলতান, হরহরি সরকার প্রমুখ কবি।
বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের কাব্যধারায় মনসামঙ্গলের কবিগণ, চন্ডীমঙ্গলের কবিগণ, ধর্মমঙ্গলের কবিগণ, কালিকামঙ্গলের কবিগণ নানাভাবে বাংলা কবিতায় অবদান রেখে ছিলেন। মঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত কবিগণ হচ্ছেন আদি রূপরাম, কেতকা দাস ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ মাধব,মানিক রাম, ময়ূর ভট্ট, খেলারাম, রূপরাম, সীতারাম দাস, শ্যামপন্ডিত, দ্বিজ বংশী দাস, কানাহরি দত্ত, নারায়ণ দেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, মাধব আচার্য, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, শ্রীশ্যাম পন্ডিত, ভরতচন্দ্র রায় গুনাকর, ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ প্রভারাম। বৈষ্ণবপদাবলি ধারার কবিরা হলেনঃ বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, দ্বিজ চন্ডীদাস, দীন চন্ডীদাস। অনুবাদ কবিতার খ্যাতিমান কবিদের মধ্যে সংস্কৃত রামায়ণ ও মহাভারত, মহাকাব্য দুটির শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি হচ্ছেন যথাক্রমে কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস ওঝা ও অন্যান্য অনুবাদক হচ্ছেন ভবানীদাস, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, চন্দ্রাবতী , অদ্ভুতাচার্য, প্রমুখ। রোমান্টিক কাব্যঃ (অনুবাদ) বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে মুসলমান রচিত শ্রেষ্ঠ কাব্যধারা হচ্ছে রোমান্সমূলক কাব্য। এই রোমান্স মূলক কাব্যগুলো পাঠক সমাজে খুব সহজেই সমাদৃত হয়। ইউসুফ-জুলেখা – শাহ মুহম্মদ সগীরের, পদ্মাবতী – আলাওলের, মধুমালতী- মুহাম্মদ কবীরের, সতীময়না-লোরচন্দ্রানী- দৌলত কাজীর, লায়লী-মজনু- দৌলত উজির বাহরাম খা । জীবনীকাব্য, শাক্তপদাবলি, দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের উল্লেখ যোগ্য কবিরা হলোঃ ফকির গরীবুল্লাহ, বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, রামপ্রসাদ, দাশু রায়, সৈয়দ হামজা, প্রমুখ।
আধুনিক যুগ
১৮০১ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত অবস্থাকে আধুনিক যুগ বলা হয়। মধ্য ও আধুনিক যুগের মধ্যে যিনি সেতুবন্ধন তৈরি করেন তিনি হলেন যুগ সন্ধি ক্ষণের কবি: ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। যাহার জন্ম ১৮১২ খ্রিঃ ও মৃত্যু ১৮৫৯ খ্রি| মাইকেল মধুসূদন দত্ত মধ্যযুগীয় পয়ারমাত্রা ভেঙে কবি প্রবেশ করেন মুক্ত ছন্দে।যাহার যাহার জন্ম ১৮২৪ খ্রিঃ ও মৃত্যু ১৮৭৩ খ্রি রচনা করেন সনেটের মত বিখ্যাত কবিতা। লাভ করেন, আধুনিক কবিতার জনকের খ্যাতি। ভোরের পাখি : ইউরোপীয় ভাবধারার রোমান্টিক ও গীতি কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী যাহার জন্ম ১৮৩৫ খ্রিঃ ও মৃত্যু ১৮৯৪ খ্রি। মহিরুহ বৃক্ষের ন্যায় বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যাহার জন্ম ১৮৬১ খ্রিঃ ও মৃত্যু ১৯৪১ খ্রিঃ। তিনি বিশ্বকবি হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত। মহাকাব্য ব্যতিত সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তিনি খ্যাতির স্তম্ভটি প্রতিষ্ঠা করেননি। রবীন্দ্রানুসারী ভাবধারার অন্যান্য কবিরা হলোঃ যতীন্দ্রমোহন বাগচী ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। বিশ শতকের শুরুতে কবিতায় পঞ্চপুরুষ রবীন্দ্রবিরোধিতা করেন, তারা হলোঃ মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত । আধুনিক কবিতার স্বর্ণযুগ: রবীন্দ্র ভাবধারার বাইরে এসে দশক প্রথার চালু করেন তিরিশের পঞ্চপান্ডব কবিঃ অমিয় চক্রবর্তী, যাহার জীবনকাল (১৯০১-৮৭), জীবনানন্দ দাশ, যাহার জীবনকাল (১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু, যাহার জীবনকাল (১৯০৮-৭৪), বিষ্ণু দে, যাহার জীবনকাল (১৯০৯-৮২), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, যাহার জীবনকাল (১৯০১-৬০)।